সাম্প্রতিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত নতুন শুল্ক নীতিগুলো বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থায় একটি বড় ধরনের ঝড় সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর উপর এই শুল্কের প্রভাব অত্যন্ত গভীর। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO) এর তথ্য অনুযায়ী, শুধুমাত্র ২০২৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৩৭৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের চীনা পণ্যের উপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছে, যা বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে।Mark in 2023-24
এই নিবন্ধে আমরা মার্কিন শুল্ক নীতির নিম্নলিখিত দিকগুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করব:
- শুল্ক আরোপের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
- বর্তমান শুল্ক কাঠামোর বিস্তারিত বিবরণ
- খাতভিত্তিক প্রভাব বিশ্লেষণ
- উন্নয়নশীল দেশসমূহের উপর প্রভাব
- ভবিষ্যত সম্ভাবনা ও উত্তরণের উপায়
১. মার্কিন শুল্ক নীতির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
মার্কিন শুল্ক নীতি বিশ্লেষণ করতে গেলে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে ২০১৮ সালের দিকে, যখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প “আমেরিকা ফার্স্ট” নীতির অংশ হিসেবে চীনের বিরুদ্ধে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করেন। এই সময়ে:
- ২০১৮ সালের জুলাই: ৩৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যের চীনা পণ্যে ২৫% শুল্ক
- ২০১৯ সালের মে: ২০০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্যে শুল্ক ১০% থেকে ২৫% এ উন্নীত
- ২০২০ সালের জানুয়ারি: “ফেজ ওয়ান” বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর
- ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর: বাইডেন প্রশাসন কর্তৃক সৌর প্যানেল, ইলেকট্রিক ভেহিকেল এবং সেমিকন্ডাক্টর খাতে নতুন শুল্ক
২. বর্তমান শুল্ক কাঠামোর বিস্তারিত বিবরণ
২০২৪ সালের প্রথম প্রান্তিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে সকল খাতে নতুন শুল্ক আরোপ করেছে:
পণ্য বিভাগ | শুল্ক হার | আরোপের কারণ | প্রভাবিত রপ্তানিকারক দেশ |
ইলেকট্রিক ভেহিকেল | ২৭.৫% → ১০০% | স্থানীয় উৎপাদন রক্ষা | চীন, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া |
সৌর প্যানেল | ১৫% → ৫০% | ডাম্পিং প্রতিরোধ | চীন, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া |
স্টিল ও অ্যালুমিনিয়াম | ১০% → ২৫% | আমেরিকান শিল্প রক্ষা | চীন, ভারত, ব্রাজিল |
সেমিকন্ডাক্টর | ০% → ৫০% | টেকনোলজি নিরাপত্তা | তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া |
চিকিৎসা সরঞ্জাম | ০% → ৭.৫% | COVID পরবর্তী স্বাস্থ্য নিরাপত্তা | জার্মানি, সুইজারল্যান্ড |
৩. খাতভিত্তিক প্রভাব বিশ্লেষণ
৩.১. ইলেকট্রিক ভেহিকেল (EV) শিল্প
- চীনের উপর প্রভাব: BYD, NIO এর মতো কোম্পানিগুলোর মার্কিন বাজার প্রবেশ প্রায় অসম্ভব
- মার্কিন ভোক্তাদের উপর প্রভাব: EV গাড়ির দাম ৩০-৪০% বৃদ্ধির আশঙ্কা
- বাংলাদেশের জন্য প্রাসঙ্গিকতা: লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি আমদানির দাম বৃদ্ধি
৩.২. টেক্সটাইল ও পোশাক শিল্প
- বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকি
- ২০২৩ সালে মার্কিন বাজারে ১৮.২ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি
- কাঁচামাল (সুতার দাম ১৫% বৃদ্ধির আশঙ্কা)
- শ্রমিক প্রতি উৎপাদন খরচ বাড়তে পারে
৩.৩. কৃষি খাত
- সয়া বিন ও গম:
- মার্কিন কৃষকদের জন্য সুখবর (স্থানীয় চাহিদা বাড়বে)
- ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার রপ্তানি বাড়বে
৪. উন্নয়নশীল দেশসমূহের উপর প্রভাব
৪.১. বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকি ও সুযোগ
ঝুঁকিসমূহ:
- RMG খাতে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি
- মার্কিন বাজারে প্রবেশাধিকার জটিলতা
- ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন
সুযোগসমূহ:
- চীন-মার্কিন বাণিজ্য সংঘাতের বিকল্প সরবরাহকারী হিসেবে আবির্ভাব
- LEED-certified ফ্যাক্টরিগুলোর জন্য প্রিমিয়াম মূল্য প্রাপ্তি
৪.২. ভিয়েতনাম ও ভারতের অবস্থান
- ভিয়েতনাম: ইলেকট্রনিক্স রপ্তানিতে ৩৫% প্রবৃদ্ধি
- ভারত: ফার্মাসিউটিক্যাল ও আইটি সার্ভিসে সুবিধা
৫. ভবিষ্যত সম্ভাবনা ও উত্তরণের উপায়
৫.১. বহুমুখীকরণ কৌশল
- বাজার বৈচিত্র্য: EU, জাপান, মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানি বাড়ানো
- পণ্য বৈচিত্র্য: হাই-এন্ড ফ্যাশন, টেকনিক্যাল টেক্সটাইলে স্থানান্তর
৫.২. আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তি
- চীন-বাংলাদেশ FTA এর সম্ভাবনা
- RCEP (Regional Comprehensive Economic Partnership) এর সুবিধা গ্রহণ
৫.৩. প্রযুক্তিগত উন্নয়ন
- Industry 4.0 বাস্তবায়ন
- সাস্টেইনেবল ম্যানুফ্যাকচারিং
৬. বিশেষজ্ঞদের মতামত
ড. আহসান এইচ মনসুর (সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক): “মার্কিন শুল্ক নীতির কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ে ৫-৭% প্রভাব পড়তে পারে। আমাদের উচিত দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক বাজারগুলোতে জোর দেওয়া।”
প্রফেসর ডেবরা স্ট্রস (হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল): “২০২৫ সালের মধ্যে এই বাণিজ্য সংঘাত একটি নতুন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মডেল তৈরি করবে, যেখানে সরবরাহ শৃঙ্খল সম্পূর্ণরূপে পুনর্গঠিত হবে।”
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক নীতি বৈশ্বিক বাণিজ্যকে একটি নতুন দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এই সংকট মোকাবিলায় নিম্নলিখিত পদক্ষেপ জরুরি:
- বাণিজ্যিক কূটনীতি জোরদারকরণ
- উৎপাদন খাতের আধুনিকীকরণ
- বৈশ্বিক মূল্য শৃঙ্খলে আরও গভীরভাবে একীভূত হওয়া
- মেধাসম্পদ ও প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ এই সংকটকে সুযোগে পরিণত করতে পারলেই কেবল বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলো ভবিষ্যতের বাণিজ্য যুদ্ধে টিকে থাকতে সক্ষম হবে।
তথ্যসূত্র
- U.S. Trade Representative (USTR) রিপোর্ট ২০২৪
- WTO বাণিজ্য পূর্বাভাস ২০২৪
- বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (BGMEA)
- ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড (IMF) এর বিশ্লেষণ
Leave a Reply