ভারত ও পাকিস্তান—দুটি পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশী, যাদের সম্পর্ক দীর্ঘকাল ধরে সংঘাত ও যুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। দেশভাগ থেকে শুরু করে কারগিল যুদ্ধ, পুলওয়ামা হামলা থেকে গুলি বিনিময়—এই দ্বৈরথের ইতিহাস দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাকে বারবার চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস
* ১৯৪৭-৪৮: প্রথম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ (কাশ্মীর যুদ্ধ)
- ঘটনা: ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর কাশ্মীরের শাসক হরি সিং ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পাকিস্তান-সমর্থিত উপজাতি যোদ্ধারা কাশ্মীরে হামলা চালায়।
- ফলাফল: ভারত জাতিসংঘের দ্বারস্থ হয় এবং জাতিসংঘ যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। কাশ্মীর দুইভাগে বিভক্ত হয়—জম্মু ও কাশ্মীর (ভারত) এবং আজাদ কাশ্মীর (পাকিস্তান)।
* ১৯৬৫: দ্বিতীয় যুদ্ধ (অপারেশন জিব্রাল্টার)
- ঘটনা: পাকিস্তান কাশ্মীরে গোপনে সৈন্য ও গেরিলা পাঠিয়ে অস্থিরতা তৈরি করে। ভারত পূর্ণ শক্তিতে প্রতিরোধ করে।
- ফলাফল: হাজার হাজার সৈন্য নিহত হয়; শেষ পর্যন্ত তাশখন্দ চুক্তি (সোভিয়েত মধ্যস্থতায়) স্বাক্ষরিত হয়।
* ১৯৭১: তৃতীয় যুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা
- ঘটনা: পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার দমন এবং ভারতমুখী শরণার্থী স্রোতের ফলে ভারত সামরিক হস্তক্ষেপ করে।
- ফলাফল: ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। পাকিস্তান ৯৩,০০০ সৈন্য আত্মসমর্পণ করে।
* ১৯৯৯: কারগিল যুদ্ধ
- ঘটনা: পাকিস্তানের সেনা ও কাশ্মীরি জঙ্গিরা কারগিল অঞ্চলের ভারতীয় চৌকি দখল করে।
- ফলাফল: ভারতের সফল অভিযানে কারগিল পুনর্দখল করা হয়। এই যুদ্ধ ভারতের সামরিক শক্তি ও কূটনৈতিক ক্ষমতার প্রমাণ।
সাম্প্রতিক সীমান্ত সংঘর্ষ ও ঘটনা (২০১৬-২০২৫)
২০১৬: উরি সেনাঘাঁটিতে হামলা
- ঘটনা: ১৮ সেপ্টেম্বর, চার জঙ্গি উরি সেনাঘাঁটিতে হামলা চালায়। ১৯ জন ভারতীয় সেনা নিহত।
- ভারতের প্রতিক্রিয়া: “Surgical Strike” চালায় ভারত, পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরে জঙ্গি ঘাঁটি লক্ষ্য করে।
২০১৯: পুলওয়ামা হামলা ও বালাকোট এয়ারস্ট্রাইক
- ঘটনা: ১৪ ফেব্রুয়ারি, জইশ-ই-মোহাম্মদের আত্মঘাতী হামলায় ৪০ জন সিআরপিএফ জওয়ান নিহত।
- ভারতের প্রতিক্রিয়া: ২৬ ফেব্রুয়ারি, ভারত বালাকোটে এয়ারস্ট্রাইক করে জঙ্গি ক্যাম্প ধ্বংস করে।
২০২০-২০২১: সীমান্তে গোলাগুলি ও যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন
- LOC-এ উত্তেজনা: উভয় পক্ষের মধ্যে গুলিবিনিময় ও মর্টার শেলিংয়ে বহু সেনা ও বেসামরিক লোক হতাহত হয়।
- ২০২১ চুক্তি: উভয় দেশ সীমান্তে যুদ্ধবিরতি মেনে চলার নতুন চুক্তি করে, কিন্তু এখনও বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ ঘটে।
- ২০২৫ ভারতের অপারেশন সিঁদুর: ৭ মে, ২০২৫ তারিখে শুরু হওয়া ভারতের অপারেশন “সিঁদুর” ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিনের চলমান উত্তেজনায় এক উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটিয়েছে। এই সামরিক অভিযানটি চালানো হয় ২২ এপ্রিল, ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পহেলগামে সংঘটিত একটি সন্ত্রাসী হামলার প্রতিক্রিয়ায়, যেখানে ২৬ জন নিহত হন — এর মধ্যে ২৫ জন ভারতীয় পর্যটক এবং একজন নেপালি নাগরিক ছিলেন। ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তান-ভিত্তিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী লস্কর-ই-তাইয়েবা এবং জইশ-ই-মোহাম্মদকে দায়ী করে, এবং দাবি করে যে এই গোষ্ঠীগুলোর পেছনে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তা ছিল।এই অভিযানের লক্ষ্য ছিল পাকিস্তান এবং পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরের ভেতরে ভারত যেসব “সন্ত্রাসবাদী অবকাঠামো” হিসেবে চিহ্নিত করেছে, সেগুলোর ধ্বংস সাধন। ২৩ মিনিটের একটি সময়সীমায় ভারতীয় বাহিনী নয়টি স্থানে অত্যন্ত নির্ভুল বিমান হামলা চালায় — যার মধ্যে ছিল বাহাওয়ালপুর, মুরিদকে, মুজাফফরাবাদ, কোটলি এবং ভিম্বার। এই অভিযানে ব্যবহৃত হয় রাফাল যুদ্ধবিমান, যা SCALP ক্রুজ মিসাইল এবং HAMMER বোমা দিয়ে সজ্জিত ছিল। ভারত জানায়, এতে প্রায় ১০০ জন সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে, যার মধ্যে জইশ-ই-মোহাম্মদের প্রধান মাসুদ আজহারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও আত্মীয়স্বজনরাও ছিল।পাকিস্তান এই হামলাগুলোকে “যুদ্ধের শামিল” বলে অভিহিত করে এবং দাবি করে, হামলাগুলো ছিল মসজিদ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো বেসামরিক স্থাপনায়। পাকিস্তান সরকার জানায়, এতে ৩১ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত ও ৫৭ জন আহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে শিশুরাও ছিল। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান দাবি করে যে তারা পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে এবং নিয়ন্ত্রণ রেখা (LoC) পেরিয়ে গোলাবর্ষণ করেছে, যার ফলে উভয় পক্ষেই অতিরিক্ত প্রাণহানি ঘটে।দুই দেশই উচ্চমাত্রার সামরিক সতর্কতায় রয়েছে। সীমান্তে গোলাগুলি চলতে থাকায় বেসামরিক হতাহতের খবর পাওয়া যাচ্ছে এবং অনেক মানুষ স্থানচ্যুত হয়েছে। পরিস্থিতি এখনো অস্থির, এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে এটি আরও তীব্রতর হতে পারে।আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই সংঘাত বৃদ্ধিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন এবং তুরস্কের নেতারা দুই দেশকেই সংযম প্রদর্শন এবং কূটনৈতিক সমাধান অনুসরণের আহ্বান জানিয়েছেন। জাতিসংঘ অঞ্চলটিতে আরও অস্থিরতা এড়াতে উত্তেজনা হ্রাসের গুরুত্বের উপর জোর দেয়।
ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের বর্তমান অবস্থা
- কূটনৈতিক সম্পর্ক: ভারতে পাকিস্তানি হাইকমিশনার নেই, কূটনৈতিক যোগাযোগ ন্যূনতম পর্যায়ে।
- বাণিজ্য: পুলওয়ামা ঘটনার পর বাণিজ্য বন্ধ।
- সাংস্কৃতিক বিনিময়: চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও পর্যটনের ক্ষেত্রেও নিষেধাজ্ঞা জারি।
সংকট সমাধানের বাস্তবমুখী উপায়
স্থায়ী কূটনৈতিক চ্যানেল স্থাপন
দুই দেশের উচিত একটি “ব্যাকচ্যানেল কূটনীতি” চালু রাখা যেখানে রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাব ছাড়াই আলোচনা অব্যাহত থাকবে।
কাশ্মীর নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা
কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন তৃতীয় পক্ষ নয়, বরং স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ ও সংবিধানিক সমাধান।
আর্থিক ও পরিবেশগত সহযোগিতা
- বাণিজ্যিক সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়ন করা সম্ভব।
- জলবণ্টন সমস্যা নিয়ে যৌথ কমিশনের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান সম্ভব।
সীমান্তে যৌথ পর্যবেক্ষণ ও কমান্ড চ্যানেল
সীমান্ত সংঘাত ঠেকাতে উভয় পক্ষের উচ্চপদস্থ সেনাদের নিয়মিত বৈঠক এবং সীমান্ত পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা জোরদার করা উচিত।
সাংস্কৃতিক বিনিময়ের পুনঃসূচনা
সাংস্কৃতিক সংযোগ যেমন সিনেমা, ক্রিকেট, এবং শিক্ষার্থীদের বিনিময় কর্মসূচি—সম্পর্কে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে।
ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধের ইতিহাস গভীর ও রক্তক্ষয়ী হলেও, ভবিষ্যৎ শান্তিপূর্ণ হতে পারে যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও জনগণের চাপ থাকে। কাশ্মীর ইস্যু হোক বা সীমান্ত সংঘর্ষ—প্রতিটি সমস্যারই রয়েছে সমাধান। সময় এসেছে, যুদ্ধ নয়, শান্তির পক্ষে এগিয়ে যাওয়ার।
Leave a Reply