কেন এই সংঘাত এত গুরুত্বপূর্ণ?
ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংঘাত আধুনিক বিশ্বরাজনীতির অন্যতম জটিল ও সংবেদনশীল ইস্যু। এটি শুধুমাত্র দুটি জাতির মধ্যে সীমিত নয়—বরং ধর্ম, জাতিসত্তা, উপনিবেশবাদ, ভূ-রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের একটি গভীর সংমিশ্রণ।
এই অঞ্চলটির প্রতি ইহুদি, মুসলিম ও খ্রিস্টানদের ধর্মীয় আকর্ষণ সংঘাতকে আরও স্পর্শকাতর করে তুলেছে। ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের দ্বন্দ্ব বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘ ও জটিল রাজনৈতিক সংঘাত। এই সংকট ধর্ম, ইতিহাস ও ভূরাজনীতির এক বিশাল সমন্বয়। এই ব্লগে আমরা এই সংকটের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করবো।
প্রাচীন ইতিহাস (খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০ – খ্রিস্টীয় ৬৩):
কানানীয় ও ফিলিস্তীয় সভ্যতা
- খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০ সাল থেকে কানানীয়রা বাস করতো এই অঞ্চলে।
- প্রাচীন কালে ফিলিস্তিন অঞ্চলটি পরিচিত ছিল “কানান” নামে।
- এখানে কানানীয়, হিব্রু, ফিলিস্তীয়, অ্যামোরাইট, মোয়াবাইট প্রভৃতি জনগোষ্ঠী বসবাস করত।
- “ফিলিস্তিন” শব্দটি আসে “পেলেশেত” (Philistia) থেকে, যা ছিল উপকূলীয় ফিলিস্তীয় জাতিগোষ্ঠীর বসতির নাম।
প্রাচীন ইসরায়েল ও জুডার রাজত্ব
- খ্রিস্টপূর্ব ১০২০ সালে ইসরায়েলি রাজা শাউল, এরপর ডেভিড ও সলোমনের নেতৃত্বে একটি মজবুত রাজ্য গড়ে ওঠে।
- সলোমনের তৈরি প্রথম টেম্পল (Holy Temple) ছিল ইহুদি ধর্মের পবিত্র স্থান।
ধর্মীয় ঐতিহ্যের জন্মভূমি
- এই ভূমি ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের কাছে পবিত্র।
- ইহুদি: জেরুজালেমে প্রথম ও দ্বিতীয় টেম্পল।
- খ্রিস্টান: যিশু খ্রিস্টের জন্ম, জীবন, এবং ক্রুশবিদ্ধতার স্থান।
- মুসলিম: ৬২১ খ্রিস্টাব্দে নবী মুহাম্মদের মিরাজ যাত্রার গন্তব্য – আল-আকসা মসজিদ।
রোমান শাসন থেকে ইসলামি শাসনে রূপান্তর (খ্রিস্টীয় ৬৩ – ১৫১৭):
রোমান বিজয় ও ইহুদি বিতাড়ন
- খ্রিস্টীয় ৭০ সালে রোমান সাম্রাজ্য দ্বিতীয় টেম্পল ধ্বংস করে এবং ইহুদি জনগণকে বিতাড়ন করে (ডায়াস্পোরা)।
ইসলামি বিজয় ও ধর্মীয় সহাবস্থান
- ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে খলিফা উমর (রা.) ফিলিস্তিন জয় করেন।
- জেরুজালেমে শান্তিপূর্ণভাবে ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিমরা সহাবস্থান করত।
ক্রুসেড ও অটোমান শাসন
- ১১-১৩শ শতকে ক্রুসেডে খ্রিস্টান বাহিনী জেরুজালেম দখল করে।
- ১৫১৭ সালে অটোমান তুর্কিরা পুরো অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে নেয় এবং প্রায় ৪০০ বছর শাসন করে।
ব্রিটিশ ম্যান্ডেট ও সিওনিস্ট আন্দোলনের উত্থান (১৯১৭ – ১৯৪৮):
বালফোর ঘোষণা (১৯১৭)
- ব্রিটিশ সরকার বলেছিল তারা ফিলিস্তিনে ইহুদি জাতির জন্য “জাতীয় আবাস” গঠনে সহানুভূতিশীল।
- এর ফলে সিওনিস্ট আন্দোলন আরও তীব্র হয় এবং ইহুদি বসতি গড়ে ওঠে।
আরবদের ক্ষোভ ও বিদ্রোহ
- আরবরা বালফোর ঘোষণাকে বিশ্বাসঘাতকতা মনে করে।
- ১৯৩৬-৩৯ সালে ফিলিস্তিনে বৃহৎ আরব বিদ্রোহ ঘটে।
হোলোকাস্ট ও আন্তর্জাতিক চাপ
- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও হিটলারের গণহত্যার পর ইহুদি শরণার্থীদের জন্য একটি নিরাপদ রাষ্ট্র গঠনের দাবি জোরালো হয়।
ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম ও আরব–ইসরাইল যুদ্ধ (১৯৪৮ – ১৯৭৩):
১৪ মে ১৯৪৮ – ইসরাইল রাষ্ট্রের ঘোষণা
- ইহুদি এজেন্সি ইসরাইল রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয়।
- এর পরপরই ৫টি আরব দেশ ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
“নাকবা” – ফিলিস্তিনিদের বিপর্যয়
- ৭.৫ লক্ষের বেশি ফিলিস্তিনি শরণার্থী হয়, গ্রাম ধ্বংস হয়, জনপদ খালি হয়।
১৯৬ ৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধ
- ইসরাইল গাজা, পশ্চিম তীর, গোলান হাইটস, সিনাই উপদ্বীপ এবং পূর্ব জেরুজালেম দখল করে।
- এটি ইসরাইলের ক্ষমতা বৃদ্ধির এক নতুন অধ্যায়।
ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ ও শান্তি প্রক্রিয়া:
PLO ও ইয়াসির আরাফাত
- PLO (Palestine Liberation Organization) ১৯৬৪ সালে গঠিত হয়।
- এর লক্ষ্য ছিল একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।
ইন্তিফাদা (১৯৮৭ এবং ২০০০)
- দুইবার ফিলিস্তিনিরা গণ-আন্দোলন শুরু করে:
- ১৯৮৭: প্রথম ইন্তিফাদা
- ২০০০: দ্বিতীয় ইন্তিফাদা
- ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনীর কঠোর দমন-পীড়ন ঘটে।
অসলো চুক্তি (১৯৯৩)
- ইসরাইল ও PLO প্রথমবারের মতো শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে।
- কিন্তু বাস্তবায়নে ব্যর্থতা ও অবিশ্বাস সংঘাতকে জিইয়ে রাখে।
আধুনিক সংঘাত (২০০৬ – বর্তমান):
হামাস বনাম ফাতাহ দ্বন্দ্ব
- হামাস গাজায়, ফাতাহ পশ্চিম তীরে শাসন করে।
- দুইপক্ষের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিভাজন ফিলিস্তিনিদের দুর্বল করে তোলে।
গাজা অবরোধ ও মানবিক সংকট
- ২০০৭ সাল থেকে গাজায় অবরোধ, খাদ্য, পানি, বিদ্যুৎ সংকট ও মানবাধিকার লঙ্ঘন।
আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও মতপার্থক্য
- ইসরাইলপন্থী ও ফিলিস্তিনপন্থী প্রচারণা আলাদা আলাদা বার্তা দেয়।
- সোশ্যাল মিডিয়ায় বিশ্বব্যাপী আন্দোলন তৈরি হয়েছে।
আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতি ও সংঘাত সমাধানের চ্যালেঞ্জ:
দুই রাষ্ট্র সমাধান – বাস্তবতা নাকি কল্পনা?
- ফিলিস্তিন ও ইসরাইল—দুই আলাদা রাষ্ট্র গঠন করার ধারণা এখনো জাতিসংঘের নীতিতে বিদ্যমান।
- কিন্তু বাস্তবায়ন অনিশ্চিত কারণ:
- বসতি নির্মাণ
- জেরুজালেমের মালিকানা
- নিরাপত্তা হুমকি
- শরণার্থী প্রত্যাবর্তনের অধিকার
শান্তি প্রক্রিয়ায় অন্তরায়
- ইসরাইলি অভ্যন্তরীণ রাজনীতি
- আন্তর্জাতিক দ্বিচারিতা
- আরব বিশ্বের বিভাজন
- মিডিয়ার পক্ষপাত
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি নাকি পরিবর্তনের সম্ভাবনা?
ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংঘাত কেবল একটি আঞ্চলিক সংকট নয়—এটি মানবাধিকারের, আত্মপরিচয়ের এবং ন্যায়বিচারের লড়াই।
এই সংঘাতের স্থায়ী সমাধানে দরকার:
- আন্তঃধর্মীয় সম্মান / ধর্মীয় সহনশীলতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান
- রাজনৈতিক সদিচ্ছা
- আন্তর্জাতিক সংহতি
- জনগণের মুক্তির চিন্তা
- দুই রাষ্ট্র সমাধান
- আন্তর্জাতিক সহায়তা ও মধ্যস্থতা
- মানবাধিকার রক্ষা
Leave a Reply